আগাম নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিতে উত্তাপ বাড়ছে
ওয়ান নিউজ ডেক্সঃ এমনিতেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরব হয়ে উঠছে রাজনৈতিক দলগুলো। এরই মধ্যে আবার হঠাৎ করে আগাম নির্বাচন নিয়ে গরম হতে শুরু করেছে রাজনীতির মাঠ।
গত ২৯ নভেম্বর, (বুধবার) নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সৌজন্য দেখা করতে যান ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত রেনসে টিরিংক। এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে রাষ্ট্রদূতকে জানান, সরকার চাইলে আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রস্তুত রয়েছে নির্বাচন কমিশন। তিনি আরো জানান, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সব ধরণের প্রস্তুতি রয়েছে নির্বাচন কমিশনের।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদার এই বক্তব্যের রেশ ধরেই রাজনীতির মাঠে আগাম নির্বাচন নিয়ে উত্তাপ বাড়তে থাকে।
এর দুই দিন পরই গত ১লা ডিসেম্বর, (শুক্রবার) জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম দলের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেছেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে যে কোনো আগাম নির্বাচনের জন্য বিএনপি প্রস্তুত রয়েছে।
বিএনপির এই নেতার বক্তব্যের পর পরই সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও এব্যাপরে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়।
একই দিন রাজধানীতে আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের যৌথসভা শেষে দলটির সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকেদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাইলে আগাম নির্বাচন দিতে পারেন। তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে যেকোনো নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের এমন বক্তব্যেই আঁচ পাওয়া যায় দেশে আগাম নির্বাচনের হাওয়া শুরু হয়েছে।
এদিকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে ইতোমধ্যেই মাঠে নেমে গেছে রাজনৈতিক দলগুলো। যদিও এসব কর্মসূচিকে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি বলতে নারাজ দুই দলের নেতাকর্মীরা। কিন্তু মাঠে নিজেদের অবস্থান দৃশ্যমান করতে সর্বশক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্তই নিয়েছে দলগুলো।
তাইতো রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি ঘিরে ইতিমধ্যেই নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনাও চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠছে নির্বাচন কমিশনও (ইসি)। রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ খুঁজছে সাংবিধানিক এই সংস্থা।
এর আগে গত ২৮ অক্টোবর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী রাজনীতির কর্মসূচির বিষয়টি সামনে চলে আসে। সে বহরে কে বা কারা হামলা করলে রাজনীতিতে এক ধরনের উত্তেজনা দেখা দেয়। তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন খুবই সহনশীলতার সঙ্গে সে পরিস্থিতি সামাল দেয়।
বিএনপির নেতাকর্মীরা অবশ্য খালেদা জিয়ার ওই সফরকে নির্বাচনী কর্মসূচি বলতে নারাজ; কিন্তু মূলত সেই সফরের পরই রাজনীতিতে নির্বাচনী উত্তাপ পরিলক্ষিত হতে থাকে।
সর্বশেষ সে উত্তাপ আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রায় দুই বছর পর গত ১২ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি সমাবেশকে কেন্দ্র করে। ওই সমাবেশ খালেদা জিয়া মূলত নির্বাচনী বক্তব্য দেন।
বিএনপিকে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়াকে সরকারের উদার রাজনীতির অংশ হিসেবেই দেখছে বিভিন্ন মহল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের সে উদারতা এবং সমাবেশে খালেদা জিয়ার ভাষণকে ঘিরে সেদিন থেকেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে এক ধরনের আস্থা দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি গত এক মাসে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে, তা ইতিবাচক। এর মধ্য দিয়ে সবাই যে নির্বাচনের দিকেই হাঁটছে তার আভাস মেলে।
দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে নির্বাচনী পথে হাঁটছে-তা দলের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে উঠে আসছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ‘সামনে নির্বাচন, দল গোছান’ বলে নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় নেতাকর্মীদের। সেদিন গণভবনে একটি জেলার নেতারা সাক্ষাৎ করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী আগামী বছরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিবেচনায় রেখে দলীয় কার্যক্রমকে ‘সুসংগঠিত’ করার নির্দেশনা দেন।
এর আগে বিভিন্ন সময় তিনি এবার নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও সব দলের অংশগ্রহণে হবে এবং বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে বলে সতর্ক করে দেন এবং দলকে সেভাবেই প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন। একইভাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ শীর্ষ নেতারা ‘যেকোনো পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে যাবে’ বলে মন্তব্য করেন। তারা বলেছেন, কোনো ষড়যন্ত্র করেও বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা যাবে না।
রাজনৈতিক সূত্রমতে, বিএনপির সমাবেশের পর থেকেই মূলত প্রকাশ্যে আসে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে বিরোধী দল বিএনপির নির্বাচনী রাজনীতির নানা কর্মসূচি। বিএনপির সমাবেশের পর নিজেদের অবস্থান জানান দিতে পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে আওয়ামী লীগ।
এ সময় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এবং প্রথম বর্ষপূতিকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াতের সহিংস রাজনীতি তুলে ধরতে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঠে নামাতে পারে দলটি। আয়োজন করতে পারে প্রতিবাদ সমাবেশেরও।
অনুরূপভাবে আরো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। এবার কক্সবাজারের আদলে সড়কপথে সিলেট বা রাজশাহী যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে খালেদা জিয়ার। এ সময় জনসংযোগ ও পথসভা করবেন তিনি। এজন্য স্থানীয় নেতাকর্মীদের প্রস্তুতি নিতেও বলা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রগুলো বলছে, বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে বাধা না দিয়ে বরং সহায়তা করার পক্ষে দলের নীতিনির্ধারকরা। সভা-সমাবেশের সুযোগ তৈরি করে দিয়েই দলটির লাগাম টেনে ধরতে চান তারা। তাদের মতে, মাঠে নামার সুযোগ দিচ্ছে না, সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হয় না বলে বিএনপির যে অভিযোগ, সেগুলোর ভিত্তিহীন প্রমাণ করতে ও ‘ষড়যন্ত্রের রাজনীতি’ বন্ধ করতেই এই কৌশল।
ক্ষমতাসীনরা মনে করছেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা দাবি নিয়ে মাঠে থাকলে আবারও সংঘর্ষে জড়াতে পারে দলটি। সে ক্ষেত্রে এখনকার মতো ভবিষ্যতেও তাদের কোণঠাসা করে রাখা যাবে। তা ছাড়া সভা-সমাবেশসহ নানা দিক নিয়ে ব্যস্ত রাখা গেলে নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র করতে পারবে না দলটি। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনী মাঠে বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হওয়া যাবে এবং সে অনুযায়ী সরকারি দলও নির্বাচনী কৌশল নিতে পারবে।
এদিকে বেশ কিছু দিন ধরেই বেশ সক্রিয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসি চাইছে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী সেনা মোতায়েন করতে, কিন্তু ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা না দিতে। একইভাবে ইভিএম ব্যবহার না করতে। তবে এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে থাকায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সংস্থাটি।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.