অসাধারণ মানব বন্ধুটি আমারই বাবা।
গত মাসের ২৭শে আগষ্ট কক্সবাজার জেলা বীর পুরুষ সাবেক রাষ্টদুত মরহুম ওসমান সরওয়ার আলম চৌং ৭তম মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হয়। গত ২০ শে সেপ্টেম্বর ২০১৩সালে মরহুম ওসমান সরওয়ার আলম চৌংস্বরনে অনন্য ভুবনের মানুষ নামে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করে প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু সংযুক্ত আরব আমিরাত কেন্দ্রীয় কমিটি এতে মরহুম ওসমান সরওয়ার আলম চৌং ৫ম সন্তান বর্তমান কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগ এর সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কাবেরী বাবার স্বরনে যে লেখাটি ছাপানো হয়েছিল তা হুবহু পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
রামু উপজেলার এক প্রত্যান্ত গ্রামের জমিদার পরিবারে বড় সন্তান জম্মের পর এক। একে সবকটি সন্তানের মৃত্যু হলে জমিদার বধূ পরান সোনা অনেক আরাধ্যে এক শবে বরাতের রাতে বাবার জম্ম হয়েছিল। মায়ের স্বপ্নযোগেই শিশুটির নাম রাখা হলো ওসমান সরওয়ার। আমার দাদী মানত করলেন শিশুটিকে মানুষের সেবাই উৎসর্গ করবেন। বিধি একজন ওসমান সরওয়ারকে বিসর্জিত করেছেন প্রতিটি ক্ষনে। নিজের পড়ার খরচ বাঁচায়ে সহপাঠিদের পড়ার সুযোগ জরে দিতেন। নিজে না খেয়ে খাইয়েছেন শিশু বয়স থেকে। আমার দাদী স্বতঃস্ফর্ত বিকাশে স্বাধীনতা দিয়েছিল উচ্চতর শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন চট্রগ্রাম ও ঢাকা কলেজে। বাবা অত্যান্ত সুদর্শন ছিলেন। তার রাজকীয় চলাফেরা সুতীব্র মেধামননে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও পালি দুটো বিষয়ে সর্বোচ্চ ড়িগ্রী অর্জন করেন এবং ছাত্র রাজনীতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৩ সালে বাবা দাদীর পছন্দেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।আমার মাও ছিল অপূর্ব সুন্দরী, প্রতীভাময়ী। শেষ বয়স অবধি আমার মা দেশ সেবার কাজে নিঃস্বার্থ সহযোগীতা দিয়েছিলেন। বিয়ের পর থেকে বাবা কক্সবাজার ফিরে এসেছিলেন। খুব তরুন বয়সে বাবা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করেন। যেখানে যা কিছু শিখেছেন তা এতদ অন্চলের মানুষগুলোর জন্য মাঝে বাস্তবে প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।অবৈতনিক শিক্ষক হিসাবেই তিনি সব চাইতে গুরুত্বারোপ করেছিলেন তা হলো দেশপ্রেম। ১৯৭১ সালে বাবা যখন সাংসদ স্বাধীনতা যুদ্ধে সংগীদের নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন। আমার মা ছোট্র চার শিমু সন্তান সহ সন্তান সম্ভবা অবস্হায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।৭১ সালের শেষের দিকে আমার জম্ম হলে বাবা চিঠির মাধ্যমে নাম পাঠালেন কাবেরী। ছোটবেলায় বাবাকে বলেছিলাম বাবা তুমিতো বাংলাকে ভালবাস তবে ভারতের নদীর নামে আমার নাম রাখলে কেন? বাবা উত্তরে বললেন আমরা ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ তাদের ২২০০০ সৈনিক মুক্তিযুদ্ধে বাংলার জন্য প্রান দিয়েছে। সেই ছোট বেলা থেকে বাবা শিখিয়েছেন দেশাত্মবোধ। কৃতঙ্গতাবোধ, মনুষ্যত্ববোধ। ৬৬ র ছয় দফা ৬৯ এর গন হত্যা ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের বাবা যেন আমাদের দৃশ্যপট দেখাতেন। স্বপ্ন দেখাতেন পুরো জেলার মানুষগুলোকে। বাঁচতে শিখিয়েছিলেন অবহেলিত নারীদের। তিনি একমাত্র ব্যক্তি যাকে দেখেছি শিক্ষা সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক একীভুত করতে পেরেছিলেন। দেশে সেবাই নিজেকে এতোই ব্যাপৃত করেছিলেন যে আমরা তাকে পেতামই না। যখন দেখা হতো কেরিয়ারিষ্ট হতে বলেননি। বলতেন ভালো মানুষ হতে হবে। বাবা নাটক লিখতেন সমাজ পরিবর্তনের। আমাদের সহযোদ্ধা হিসাবে এই সব নাটকে রাখতেন। আমি বাবার সাথে মফস্বলে, শহরে নাটক ও আবৃতি করে বেড়াতাম। কখনো মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভাবেননি। যা আমাকে স্বাবলম্বী করে রেখেছে আজ পর্যন্ত। ১৯৮৮ সাল। আমি তখন কিশোরী। ফুফুদের মুখে শুনলাম বাবার মিথা খারাপ হয়ে গেছে, বাবাকে দেখতে বাড়ি থেকে কক্সবাজার শহরে আসলাম। বিমানবন্দর সংলগ্ন ডোবার পাশে রিকশাওয়ালা আমাকে নামিয়ে বললেন ওসমান স্যার ওই ডোবাই বসে থাকেন। আমি দেখলাম ভরা ডোবার মাঝে একটি ছোট্র কুড়ে ঘর কোমর পানি ডিঙ্গিয়ে ঘরটির দরজায় গিয়ে দেখি ভাঙ্গা টুলে পিয়ন মিজান ঝিমুচ্ছে। আমাদের দেখে ভাঙ্গা গলায় বললো স্যারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে এই ডোবাই নাকি কলেজ করবে, আমি দেখলাম হাটু পানিতে ভাঙ্গা চেয়ার টেবিল বসে কিছু আকছেন।শরীরের অবস্হা ভয়াবহ ক্ষীন আমি অস্ফুটস্বরে বললাম বাবা ——- সেই বর্ষার জল আর আমার চোখের জল যেন একাকার হলো। বাবা আত্নবিশ্বাসে বললেন এটা আমার কলেজ,, আমি বললাম বাবা চলো বাড়ি যাই, বাবা আবৃত্তি করার অনুরোধ রাখলেন। আমি কাঁধছি বাঁধভাঙ্গা। পাগল বাবা আবৃত্তি করতে থাকলেন। মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই” নহে কিছু মহিয়ান। বললেন কলেজটি হবেই। একজন ওসমান সরওয়ার আলম চৌং এর পাগলামী ছিল বলেই কক্সবাজার মহিলা কলেজ। আজ মহীরুহে পরিনত হয়েছে। প্রতিষ্টা করেছেন অনেক বিদ্যাপীঠ, খেলাঘর, মাদ্রাসা মসজিদ, মন্দির, ও সাংস্কৃতি কেন্দ্র। হাসপাতালের বেড়ে বাবা যখন সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে যাওয়ার প্রহর গুনছিলেন বারবার বলতেন “আমি চেষ্টা করেছিলাম “। তখন মনের কাছে মনে মনে চিৎকার করে বলতাম বাবা তুমি সফল যোদ্ধা। তুমি মহা সংস্কারক একাত্ম করেছো সংস্কৃতি, সমাজ, ও শিক্ষা ব্যবস্হা। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে তুমি মুক্তি দিয়েছো সমাজকে। তুমি শিখিয়েছো সহমর্মিতা, ভালবাসা দেশকে তীর্থস্থান, তুমিই বলেছিলে। তুমি রচনা করোছিলে হাজার বছরের গৌরবান্বিত উপাখ্যান, আমার স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর তোমান মেয়ের পাশে দাড়িয়ে শিখিয়েছিলে স্বনির্ভর হতে। বলেছিলে the best architect is hinsctf, তোমার আদর্শ বঙ্গবন্ধু, তোমার সোনার বাংলা আলোকবর্তিকা, তুমিতো তুলে দিয়েছিলে এ জেলার মানুষের হাত। কাঁদতে শিখিয়েছো দেশের তরে, ভালবাসতে শিখিয়েছো মানুষকে, বন্ধু হয়ে আলো জ্বালিয়েছো ঘরে ঘরে,মানুষে মানুষে সমাজে সমাজে। এতো প্রিয় কন্ঠে এতো অতৃপ্তি নিয়ে কিভাবে বলতে পারো বাবা তুমি শুধু চেষ্টা করেছিলে।
আজ কৃতজ্ঞতা জানাবার সময় আমার মাকে। যিনি বাবার হাতের কাছে নিজের হাত প্রসারিত করেছিলেন। কৃতজ্ঞতা জানাইযারা মৃত্যুর পরও তার কর্মকান্ড়ের প্রতি কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতা জানাই সেসব সহযোদ্ধা বন্ধুদের যারা বাবার কাজ অনুসরনে দেশ ও মানবিক মুল্যবোধ গঠনে নিজেদের নিবেদিত রেখেছেন।
লেখকঃ নাজনীন সরওয়ার কাবেরী
(মরহুম ওসমান সরওয়ার আলম চৌং ৫ম সন্তান।)
সাংগঠনিক সম্পাদক
কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগ।
কক্সবাজার।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.