ডেস্ক নিউজ:
জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটকে ‘মানুষের জন্য বাজেট’ এবং ‘স্বপ্ন পূরণের বাজেট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। বিগত অর্থবছরের তুলনায় যা ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বেশি।
বৃহস্পতিবার (৩ জুন) নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি রয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। ঘাটতি মোকাবিলায় বৈদেশিক অর্থায়ন থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে নেওয়া হবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে ৩৭ হাজার ১ কোটি টাকা যোগাড় করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বাজেট ঘাটতির এই হার জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
এদিকে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২০ শতাংশ ধরা বাস্তবোচিত হয়নি বলে অভিমত দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। করোনাভাইরাস মোকাবিলা এবং মহামারি থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য যে বাজেট প্রয়োজন ছিল, তাও বাজেটে নেই বলে মনে করছে সিপিডি।
প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আগামী বছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দের পরিমাণ বেড়েছে ৭২৬ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরের জন্য এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে মোট জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সকল প্রকার বিলাসী পণ্য বিশেষ করে আমদানি করা বিদেশি পণ্যের ওপর ট্যাক্স ধার্য করেছেন। বাড়ির নকশা অনুমোদন করতে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। এর ফলে শহরে বা গ্রামে যেকোনও জায়গায় বাড়ি করতে হলে টিআইএন নিতে হবে। এতে বাড়ির মালিক করের আওতায় আসবেন।
এ ছাড়া যে কোনও সমবায় সমিতির নিবন্ধনের ক্ষেত্রেও টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর আগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রাখার কথা বলা হলেও অর্থমন্ত্রী তার প্রস্তাবিত বাজেটে সুনির্দিষ্ট করে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেনি।
করোনার নেতিবাচক প্রভাবে সাধারণ অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এ কারণে প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বলয়ের পরিধি বাড়িয়ে বরাদ্দ ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়িয়েছে সরকার। বয়স্ক ভাতার সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে ৮ লাখ।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানি প্রস্তাব করা হয়েছে ২০ হাজার টাকা। আগে যা ছিল ১২ হাজার টাকা। ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে বাল্যবিবাহ নির্মূলের পরিকল্পনাও রয়েছে বাজেটে।
অপ্রত্যাশিত করোনা নির্মূলের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাখাতে ৩২ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বাইরে করোনা মোকাবিলায় এবারও থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা।
স্বাস্থ্যখাতের অর্জনগুলোকে টেকসই করা ও ভবিষ্যতে মহামারি হতে রক্ষা পেতে মানসম্পন্ন গবেষণাভিত্তিক স্বাস্থ্যশিক্ষার সম্প্রসারণে আগামী অর্থবছরেও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতার জন্য বিদ্যমান করহার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ফলে ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা এ বছরও ৩ লাখ টাকা থাকছে। এবার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরের তুলনায় ১১ হাজার কোটি টাকা বেশি। মোট আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর থেকে আসবে ১৬ হাজার কোটি টাকা।
বৈদেশিক অনুদান ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা।
বিভিন্ন মহল থেকে তামাকের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে সকল প্রকার গুল, জর্দা, বিড়ি, সিগারেটের উপর ট্যাক্স ধার্য করার অনুরোধ থাকলেও বিড়ি জর্দা, গুল ও নিম্নমানের সিগারেটের ওপর কোনও ট্যাক্স ধার্য করা হয়নি। উচ্চমানের সিগারেটে যে হারে ট্যাক্স ধার্য করা হয়েছে তাতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তামাকবিরোধী সংগঠনের কর্মকর্তারা।
অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটে লৌহজাত পণ্য প্রস্তুতে ব্যবহার্য কতিপয় কাঁচামাল, স্ক্র্যাপ ভেসেল এবং পিভিসি, পিইটি রেইজিন উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ইথানেল গ্লাইকলসহ বিভিন্ন পণ্যে আগাম কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। শুল্ক-কর কমানোর ফলে রড সিমেন্টসহ বেশ কিছু নির্মাণ সামগ্রীর দাম কমছে।
প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন বাজেটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন ২০১-২০২২ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, বাজেট উপস্থাপনই বড় কথা নয়। বাজেট বাস্তবায়নই বড় কথা। বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। দক্ষতা বাড়াতে হবে।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.