অপার সম্ভাবনাময় রত্নগর্ভা সোনাদিয়া দ্বীপ

ওয়ান নিউজঃ মহেশখালীর অপার সম্ভাবনাময় সোনাদিয়া দ্বীপ। এই দ্বীপের নামকরণের সঠিক কোনো ঐতিহাসিক তথ্য না থাকলেও জনশ্রুতি রয়েছে, স্থানীয়দের কাছে সোনা সমতুল্য দামি পণ্য প্রচুর মৎস্যসম্পদ আহরিত হতো বলে এই দ্বীপ সোনার দ্বীপ তথা সোনাদিয়া বলে পরিচিতি লাভ করে। দ্বীপটি সোনাদিয়া হিসেবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে এবং পাঠ্যবইয়ে স্থান পেয়েছে। পর্যটনের জন্য সম্ভাবনাময় সোনাদিয়া পরিকল্পিত উন্নয়নের অভাবে এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। শীত মওসুমে কক্সবাজারে আসা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ সোনাদিয়া হলেও এখন পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে এই দ্বীপ। ফলে পর্যটনকে ঘিরে সোনাদিয়ায় গড়ে ওঠা ব্যবসাপাতি অচল হয়ে পড়েছে।

 

জানা যায়, কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের একটি আকর্ষণীয় বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সোনাদিয়ায় ৪৯২৮ হেক্টর জমি রয়েছে। পূর্ব-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয় সোনাদিয়া দ্বীপের বাসিন্দাদের। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এ দ্বীপের দৃষ্টিনন্দন প্যারাবন জমির পরিমাণ প্রায় ২২০০ একর। এ ছাড়া রয়েছে নৈসর্গিক সমুদ্র সৈকত।

 

কুতুবজোম ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আবদুল গফুর প্রকাশ নাগু মেম্বার জানিয়েছেন, অসংখ্য লাল কাঁকড়া রয়েছে সোনাদিয়া দ্বীপে। এসব কাঁকড়া পূর্ব পাশে জেগে ওঠা চর সোনাদিয়ার আকর্ষণ বাড়িয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিমসহ দ্বীপবাসীর নিজস্ব সংস্কৃতি ও সাদামাটা জীবনযাপন সবাইকে আকৃষ্ট করে। পূর্ব পাড়ার হজরত মারহা আউলিয়ার মাজার ও তার আদি ইতিহাস, জেলেদের সাগরের মাছ ধরার দৃশ্য, সূর্যাস্তের দৃশ্য, প্যারাবন বেষ্টিত আঁকাবাঁকা নদীপথে নৌকা ভ্রমণ, স্পিড বোট বা ইঞ্জিন বোট দিয়ে মহেশখালী চ্যানেল হয়ে সাগরের মাঝপথে বঙ্গোপসাগরের দৃশ্য অবলোকন পর্যটকদের জন্য ব্যতিক্রমধর্মী বাড়তি আকর্ষণ। তবে এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ দ্বীপে সরকারি বা বেসরকারিভাবে পর্যটন শিল্প বিকাশে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন করা হলে পর্যটন শিল্পে অবদান রাখতে পারবে দ্বীপটি। কক্সবাজার শহরের নিকটবর্তী দ্বীপটি পর্যটন বিকাশে অন্যতম স্থান হতে পারে যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে সচেতন মহলের অভিমত। কুতুবজোম ইউনিয়নের বাসিন্দা খাইরুল আওয়ারা জানান, প্রতি মওসুমে বিপুল পর্যটক সোনাদিয়ায় আসতেন। পর্যটকদের কেউ স্পিড বোটে করে, কেউবা আসতেন মহেশখালীর কুতুবজোম হয়ে সড়কপথে। পর্যটকদের ঘিরে গড়ে ওঠে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বর্তমানে পর্যটক আসা শূন্যের কোঠায় চলে আসায় ওই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

 

 

পরিবেশবিদদের মতে, সোনাদিয়া দ্বীপ সরকার ঘোষিত পরিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী এ দ্বীপে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এমন সব কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। এই দ্বীপে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে ইকো ট্যুরিজমের উন্নয়ন বিকাশ অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই দ্বীপে দ্বীপবাসীর সম্পৃক্ততায় কমিউনিটিভিত্তিক ইকো ট্যুরিজমের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে; যা দ্বীপবাসীর বিকল্প আয়ের ব্যবস্থাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।

 

সোনাদিয়ায় লোকসংখ্যা: বর্তমানে ৮১০ জন বাস করেন সোনাদিয়ায়। ২০১২ সালের তথ্য অনুযায়ী ভোটারসংখ্যা ৩৮৪ জন। স্থানীয় লোকজন মূলত মৎস্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিছু পরিবার চিংড়ি ও লবণ উৎপাদন পেশায় জড়িত আছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও খুবই পরিশ্রমী। পুরুষেরা চিংড়ি ও সমুদ্রে গিয়ে মাছ আহরণে ব্যস্ত থাকলেও মেয়েরা পুরুষদের আহরিত মাছগুলো বাজারজাতকরণের যাবতীয় কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। মাছ শুকানো ও গুদামজাত সম্পন্ন করেন নারীরাই। বিশেষ করে শীত মওসুমে শুকানো বিভিন্ন প্রজাতির শুঁটকি মাছ দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। তাই কক্সবাজারে পর্যটনে আসা কোনো পর্যটকই সোনাদিয়ার শুঁটকি ছাড়া ঘরে ফিরতে চান না।

 

সোনাদিয়ায় শিক্ষাব্যবস্থা: সোনাদিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা তেমন কোনো উল্লেখ করার মতো নয়, তবে পশ্চিম পাড়া আর উত্তর পাড়ায় একটি করে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান তেমন ভালো নয়। স্থানীয় লোকজন ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে চান না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোলেই মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় লেখাপড়া থামিয়ে দিতে হয়।

 

দৃষ্টিনন্দন প্যারাবন: সোনাদিয়ার প্যারাবন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলের একমাত্র লোনাজলের প্যারাবন। পূর্ব পাশে মহেশখালী চ্যানেল এবং পশ্চিমে কোহেলিয়া নদী। এ অঞ্চলে সাদা বাইন, কালো বাইন, কেওড়া, হরগোজা, নোনিয়াসহ প্রায় ত্রিশ প্রজাতির প্যারবনসমৃদ্ধ উদ্ভিদ বিদ্যমান।

 

জীববৈচিত্র্য: পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, সোনাদিয়ার খাল, মোহনা, চর ও বনভূমিতে উনিশ প্রজাতির চিংড়ি, চৌদ্দ প্রজাতির শামুক, ঝিনুক, নানা ধরনের কাঁকড়ার মধ্যে রয়েছে রাজ কাঁকড়া, হাব্বা কাঁকড়া, জাহাজি কাঁকড়া, সাঁতারো কাঁকড়াসহ প্রায় আশি প্রজাতির সাদা মাছ, পঁয়ষট্টি প্রজাতির (বিপন্নপ্রায়) স্থানীয় ও যাযাবর পাখি এবং অন্তত তিন প্রজাতির ডলফিন বিচরণ করে থাকে। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মাছের মধ্যে কোরাল, বোল, বাটা, তাইল্লা, দাতিনা, কাউন (কনর মাছ) ও প্যারাবন এলাকার অন্যান্য মাছ পাওয়া যায়। এই দ্বীপে উৎপাদন করা হয় এক প্রকার সাগরের বুকে ভেসে আসা চরে কত্তাল। ওই কত্তালের পেট থেকে মুক্তা পাওয়া যায় এই রত্নগর্ভা সোনাদিয়া দ্বীপে।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.