অনুমতির গণতন্ত্র!

গতবছর ২২ ও ২৩ অক্টোবর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বর্ণাঢ্য কাউন্সিল করেছে আওয়ামী  লীগ। দুদিনের কাউন্সিল উপলক্ষ্যে গোটা মাসজুড়ে দখল ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আর কাউন্সিলের দুদিন তো ঢাকার অনেকটাই ছিল আওয়ামী লীগের দখলে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষ্যে সোওরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। গত ১ জানুয়ারি ছিল জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। এ উপলক্ষ্যে দলটি সমাবেশ করেছে সোহওরাওয়ার্দী উদ্যানে। খুব ভালো কথা। রাস্তা আটকে সমাবেশ না করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করা ভালো লক্ষণ। তবে খেয়াল রাখতে হবে ঘন ঘন সমাবেশ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বৃক্ষ বৈচিত্র্য যেন নষ্ট না হয়। তবে আমার মূল আপত্তি অন্যখানে। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের কয়েকদিন পরেই বিএনপি ৭ নভেম্বর উপলক্ষ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি চায়। কিন্তু অনুমতি মেলেনি। শেষ পর্যন্ত নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে চেয়েছিল, সে অনুমতিও পায়নি তারা।

৭ নভেম্বর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ঐতিহাসিক দিন। বিএনপির আনুষ্ঠানিক জন্ম ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। কিন্তু বিএনপির আদর্শিক জন্ম আসলে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। দিনটি বিএনপি পালন করে বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে। তবে এটা খুব বিস্ময়কর, বিএনপি সেদিন কোন বিপ্লবকে স্মরণ করে? কারণ ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তো আসলে জাসদ বিপ্লব করতে চেয়েছিল। গৃহবন্দী জিয়াউর রহমানও শুরুতে কর্নেল তাহেরের বিপ্লবের স্ক্রিপ্ট ফলো করেন। পরে সময়মত পাল্টি মারেন। যাই হোক, ৭ নভেম্বর পালন নিয়ে ভিন্নতা থাকতে পারে। আওয়ামী লীগ ও জাসদ দিবসটি পালন করে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস হিসেবে। সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ তাদের কথা বলবে, বিএনপি তাদের কথা বলবে; এটাই গণতন্ত্র, এটাই গণতান্ত্রিক চেতনা। কিন্তু আওয়ামী লীগ একাই সমাবেশ করবে, কাউন্সিল করবে; বিএনপিকে রাস্তায় নামতেই দেয়া হবে না; এটা অগ্রহণযোগ্য, এটা গণতন্ত্র নয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ ৫ জানুয়ারি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি দেশের প্রধান দুই দলের একটি বিএনপি। বরং তারা নির্বাচন ঠেকানোর ব্যর্থ আন্দোলন করে। নামে আন্দোলন হলেও তা ছিল প্রাণঘাতী নিষ্ঠুর নির্মমতা। ২০১৫ সালে নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতেও আন্দোলনের নামে ব্যাপক নাশকতা করে বিএনপি, টানা ৯২ দিন অবরোধ পালন করে। বিএনপি বারবার বলার চেষ্টা করে, তারা আন্দোলন করলেও নাশকতা করেনি। ‘অন্য কেউ’ সহিংসতা করে, তাদের ওপর দায় চাপাতে চাইছে। কিন্তু বিএনপি যতই অস্বীকার করুক, তাদের আন্দোলনের কারণেই মানুষের প্রাণ গেছে। ‘অন্য কাউকে’ সহিংসতা করার সুযোগ দিয়েছে বিএনপি ঘোষিত আন্দোলন কর্মসূচিই। ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন নির্বাচনে ভোট হওয়ার আগেই ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। আইনগতভাবে সে নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে কোনো সমস্যা না থাকলেও নির্বাচনের নৈতিক বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বারবার। এমনকি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলের নেতাকর্মীদের আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, আগামীতে আর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হবে না। তার মানে শেখ হাসিনাও পরোক্ষে স্বীকার করে নিলেন, গত নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগের দাবি, বিএনপি না এলেও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যই নির্বাচনটি করতে হয়েছে। আর বিএনপি নেতারা বলেন, এই নির্বাচনে গণতন্ত্রের নামে কলঙ্ক।

সুশীল সমাজের ধারণা, বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে বড় ভুল করেছে। এই ভুল তাদের সংসদের বাইরে ছিটকে দিয়েছে। আর এখন সরকার তাদের রাজপথ থেকে ছিটকে ফেলছে। আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারি পালন করে ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ হিসেবে। আর বিএনপি পালন করে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে। কোনো অসুবিধা নেই। দুই দল আলাদাভাবেই দিনটি পালন করবে। করুক। কিন্তু ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ঢাকায় রাজপথ আটকে দুটি সমাবেশ করেছে। আর বিএনপি সারাদেশে কালো পতাকা মিছিল করতে গিয়ে অন্তত ১৬ জেলায় পুলিশের বাধার মুখে পড়েছে। বরিশালে পুলিশের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। হামলায় তারা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে পিটিয়েছে। ৫ জানুয়ারি উপলক্ষ্যে বিএনপি ৭ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে চেয়েছিল। অনুমতি পায়নি। না হলে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে হলেও সমাবেশ করতে চেয়েছিল। অনুমতি পায়নি। কেন? এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে?

বলা হয়, রাজপথে সমাবেশ করলে জনদুর্ভোগ হয়। অবশ্যই হয়। কিন্তু সেটা তো শুধু বিএনপি করলে হয় না, আওয়ামী লীগ করলেও হয়। ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে গিয়ে নগরবাসীকে যানজট উপহার দিয়েছে, পরদিন ৫ জানুয়ারির সমাবেশ করে একই দুর্ভোগের পুনরাবৃত্তি করেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ যা করতে পারবে, বিএনপি তা করতে পারবে না কেন? বলা হয়, বিএনপিকে সমাবেশ করতে দিলেই তারা সহিংসতা করবে। সহিংসতা করতে পারে, এমন কাল্পনিক অভিযোগ এনে বিএনপি সমাবেশ করার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কোনোভাবেই গণতন্ত্র নয়।

২০১৫ সালের টানা ৯২ দিনের অর্থহীন অবরোধের পর থেকে বিএনপির মধ্যে একধরনের রিয়েলাইজেশন এসেছে। বিএনপি প্রাণপণে নিজেদের সহিংসতার ধারা থেকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠার জন্য সবার উচিত বিএনপিকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসতে সহায়তা করা। বিএনপি ২০১৪ ও ২০১৫ সালে কী করেছে, তা দিয়ে তো তাদের সারাজীবন অপরাধী বিবেচনা করা যাবে না। বিএনপি তো নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল নয়। ২০১৪ ও ২০১৫ সালের নাশকতার জন্য বিএনপি নেতাকর্মীদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাদের বিচার চলছে। আবার যদি তারা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে, আবার মামলা হবে, বিচার হবে। কিন্তু দুই বছর আগের অপরাধ দিয়ে এখন তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রুদ্ধ করা যাবে না, করা উচিত নয়। এভাবে বারবার গণতান্ত্রিক অধিকার রুদ্ধ করে বিএনপিকে কি আবার সহিসংসতার দিকে যাওয়ার উসকানি দেয়া হচ্ছে? অতীতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নামে নাশকতার অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসঙ্গী জাসদের পঁচাত্তর পূর্ব ভূমিকা দিয়ে নিশ্চয়ই এখন তাদের অবস্থান নির্ধারিত হবে না।

গত দুই বছর দেশে দারুণ স্থিতিশীলতা রয়েছে। এর মূল কৃতিত্ব অবশ্যই সরকারের। তবে বিএনপিও এই সময়ে অনেক সংযত ছিল। তাই স্থিতিশীলতার কৃতিত্ব তাদেরকেও দিতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সুযোগে দেশের অর্থনীতি এগুচ্ছে দারুণ গতিতে। অর্থনীতি ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অর্জন অবশ্যই আমাদের গর্বিত করে। কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে উন্নয়ন টেকসই হয় না। আমরা চাই গণতান্ত্রিক পরিবেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.